কবিগানের প্রতি খুদে বিজ্ঞানীদের উন্মাদনা..

সালটা ২০০৮, পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ থেকে আমার কাছে ডাক এল রাজ্য বিজ্ঞান মেলায় বিজ্ঞানভিত্তিক কবিগান গাইতে হবে৷ মহান বাঙালি বিজ্ঞানী আচার্য্য জগদীশচন্দ্র বসুর সার্ধশতজন্মবার্ষিকীতে কলকাতার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে রাজ্য বিজ্ঞান মেলার আয়োজন করা হয়েছে৷ পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত জেলা থেকে বাছাই করা স্কুলপড়ুয়া খুদে বিজ্ঞানীরা তাদের অভিনব আবিস্কার এই মেলায় প্রদর্শন করবেন এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য প্রত্যেকের হৃদয়ে উদ্ভাসিত বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা মেলার কর্মশালায় ব্যক্ত করবেন৷ আমরাও আনন্দিত হলাম এ কথা ভেবে যদি কর্মকর্তাদের কাছে বিজ্ঞানমনস্কতার কিছু নতুন কথা শোনাতে পারি খুব ভাল লাগবে৷
যাইহোক, মহান বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর জন্মদিনে অর্থাৎ ৩০ নভেম্বর আমি আমার কবিগানের দল “যামিনী রামকিঙ্কর কবিগান ট্রুপ” নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম কলকাতার উদ্দেশ্যে৷ দুপুর বারোটা নাগাদ যুবভারতী স্টেডিয়ামে পৌঁছলাম এবং স্নান সেরে মধ্যাহ্নভোজন করলাম৷ স্টেডিয়ামের গেস্ট হাউসে অর্থাৎ ভিভিআইপি অতিথিশালায় আমাদের বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হল৷ ক্লান্তিঘুম থেকে উঠে সন্ধ্যেবেলায় টিফিন করে ধুতিপাঞ্জাবী পরে গানের জন্য প্রস্তুত হলাম৷
সাংস্কৃতিক মঞ্চের চেয়ারে বসে বিজ্ঞান সচেতনতার বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখলাম ও জ্ঞানলাভ করলাম৷ অবশেষে আমরা কবিগান পরিবেশনার জন্য ডাক পেলাম রাত্রি আটটায়৷ মঞ্চে তখন পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ হতে মাননীয় সৌরভ চক্রবর্তী ও যুবকল্যান বিভাগ হতে মাননীয় সৌমিত্র লাহিড়ী আমাদের যামিনী রামকিঙ্কর কবিগান ট্রুপকে আহ্বান জানালেন কবিগান পরিবেশনার জন্য৷ সংক্ষিপ্ত গৌরচন্দ্রিকা সেরে আমরাও বিজ্ঞান চেতনার সাগরে ডুব দিলাম৷

তখন বামফ্রন্টের আমল, মাননীয় সুভাষ চক্রবর্তী রাজ্যের ক্রীড়া ও পরিবহণ মন্ত্রী৷ তিনি তিরিশ মিনিট ধরে খুব মনোযোগ সহকারে আমাদের কবিগান শুনলেন এবং উচ্চ প্রশংসা করলেন৷ হঠাৎ ঘোষিত হল ডান্স বাংলা ডান্সের শ্যুটিং শেষে মিঠুন চক্রবর্তী আসছেন ক্ষুদে বিজ্ঞানীদের সাথে আলাপ করতে৷ আমি তখন বিজ্ঞানের ভূমিকায় যুক্তিতর্কের এক চরম মুহূর্তে৷ সকলেই নিশ্চুপ হয়ে খুব মন দিয়ে কবিগান শুনছেন৷ অকস্মাৎ সুপারস্টার হাজির হলেন৷ মাননীয় ক্রীড়ামন্ত্রী মিঠুনবাবুকে এসকর্ট করে মঞ্চে নিয়ে এলেন৷ উনি সুভাষবাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে মঞ্চে দাঁড়ালেন৷ আমরা তিনজন তখন মঞ্চে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে— বাঁদিকে সুভাষ চক্রবর্তী, মধ্যিখানে মিঠুন চক্রবর্তী আর ডানদিকে আমি গণেশ ভট্টাচার্য৷ এত বড় একজন সুপারস্টারকে সামনে পেয়ে সকলের ছবি তোলার হুড়োহুড়ি পড়ে গেল৷ কিন্তু দুঃখের বিষয়, তখন আমার কাছে ভাল মোবাইল না থাকার জন্য ছবিটা আপনাদের দেখাতে পারলাম না৷ যাইহোক, সকলে সুভাষবাবুকে অনুরোধ করলেন কবিগানের একটা পয়ার ছন্দ গেয়ে শোনানোর জন্য৷ উনি বাংলাদেশের প্রখ্যাত কবিয়াল বিজয় সরকারের এক চরণ গান গেয়ে শোনালেন৷ প্রায় কুড়ি মিনিট থাকার পর মিঠুন চক্রবর্তী বিদায় নিলেন ও সাথে সাথেই সুভাষ চক্রবর্তীও প্রস্থান করলেন৷ আর এদিকে কবিগানের অনুষ্ঠানও লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল৷ খুদে বিজ্ঞানী ও রাজ্য বিজ্ঞান মেলার উদ্যোক্তাদের সাথে আমরাও তৎক্ষণাৎ পোলাও ও খাঁসি মাংস দিয়ে নৈশাহারে প্রবৃত্ত হলাম৷ ভোজনকালীন একে একে সকলেই আমার ও কবিগান টিমের বাকি সদস্যদের কাছে এসে কবিগানের প্রশংসাপূর্বক খুব দুঃখপ্রকাশ করতে লাগলেন— “এত সুন্দর একটা শিক্ষামূলক মজার অনুষ্ঠান হচ্ছিল, এত বড় স্টার এসে সব লণ্ডভণ্ড করে দিলেন৷” সকলকে আমি শুধুমাত্র একটা কথা বলেই সান্ত্বনা দিলাম— “মেগাস্টার এলে ডিজাস্টার তো হবেই৷”