KABIGAAN.. AFTER FREEDOM
স্বাধীনোত্তর যুগে কবিগানের লড়াই..

কবিয়াল গণেশ ভট্টাচার্য
বঙ্গদেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষামূলক ও ঐতিহ্যপূর্ণ লোকগান হল কবিগান৷ কবিগানের উৎপত্তি ও গৌরবময় কাল বিষয়ে বিদগ্ধ গবেষকগণ নানা গ্রন্থে প্রচুর লেখালেখি করেছেন৷ তবে প্রাচীন কবিগানের বেশির ভাগটাই কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তাঁর “সংবাদ প্রভাকর” পত্রিকায় লিপিবদ্ধ করেন৷ উক্ত পত্রিকার ১২৬১ সনের ১ লা অগ্রহায়ণ সংখ্যায় তিনি গোঁজলা গুঁইকেই প্রথম কবিয়াল হিসেবে চিহ্নিত করে লালু-নন্দলাল, রঘুনাথ দাস ও রামজী দাস- তাঁর এই শিষ্যগুলির কথা উল্লেখ করেন৷ এ বিষয়ে বিভিন্ন আঞ্চলিক গবেষকগণ তাঁদের নিজ নিজ রচনায় নানা স্বাধীন মত পোষণ করেছেন৷
স্বাধীনতা পূর্ববর্তী যুগে কবিগানের সূচনাকাল হতে কবিগানকে কয়েকটি পর্বে বিভক্ত করা হয়৷ বাংলার ঐতিহ্যপূর্ণ লোকসঙ্গীত ও জনসাহিত্য কবিগানের প্রবহমানকালের সাধারণভাবে তিনটি পর্ব লক্ষ্য করা যায়৷ যথা— ক) প্রাক ১৭৬০ খ্রীঃ পর্ব, খ) ১৭৬০—১৮৩০ খ্রীঃ পর্ব ও গ) ১৮৩০ খ্রীঃ উত্তর পর্ব৷ এর মধ্যে দ্বিতীয় পর্বটি কবিগানের সবচেয়ে প্রাচুর্যযুক্ত ও বাড়বাড়ন্ত কাল৷ কবিগানের প্রাপ্ত ইতিহাসের প্রথম পর্বের প্রাচীনতম কবিয়াল গোঁজলা গুঁই ও তাঁর তিন শিষ্য লালু-নন্দলাল, রঘুনাথ দাস ও রামজী দাস৷ এরপর দ্বিতীয় পর্ব অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ হতে শুরু হয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর চতুর্থ দশক পর্যন্ত স্থায়ী হয়৷ কবিগানের এই সর্বশ্রেষ্ঠ যুগের উজ্জ্বল কবিয়ালগণ রাসু-নৃসিংহ, হরু ঠাকুর, নিতাই বৈরাগী, ভবানী বেনে, রাম বসু প্রমুখ৷ ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভোলা ময়রা, এন্টনী ফিরিঙ্গী, যজ্ঞেশ্বরী আদি কবিয়ালগণ কবিগানের তৃতীয় পর্বের সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বজনবিদিত৷ থিয়েটার ও অন্যান্য পাশ্চাত্য সংগীত উদ্ভাবনের ফলে কবিগান অতঃপর শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে মোড় নেয়৷ বিংশ শতাব্দীতে গ্রামগঞ্জে পুণরায় অনেক গুণী কবিয়াল জন্মগ্রহণ করেন, যাঁদের মধ্যে রমেশ শীল, শেখ গুমানি দেওয়ান, লম্বোদর চক্রবর্তী, বিজয় সরকার প্রমুখ কবিগানকে সম্পদশালী করেছেন৷
১৯৪৭ সালের ১৫ আগষ্ট বর্বর ব্রিটিশ শাসনাধীন থেকে আমাদের দেশ মুক্ত হয়৷ শুধু ইংরেজরা নয়, ফরাসী-পর্তুগীজ-ওলন্দাজরাও আমাদের বঙ্গ ও ভারত মাতার বিবিধ রতন লুণ্ঠন করে স্বদেশে নিয়ে যায়৷ এদিকে দীর্ঘদিন বঙ্গদেশে তাঁবু খাটানোর ফলে বিদেশী সাহেবরাও এ দেশীয় সংস্কৃৃৃৃৃতিতে নিমজ্জিত হয়ে কবিগানের প্রতি অনুরক্ত হন এবং তার প্রকৃৃৃৃৃৃৃষ্ট উদাহরণ কবিয়াল এন্টনী ফিরিঙ্গী৷ পর্তুগাল থেকে আগত এন্টনী সাহেবের আসল নাম হেন্সম্যান এন্টনী, তিনি ছিলেন জাতিতে ফিরিঙ্গী৷ এই পর্তুগীজ বণিক ব্যবসাসূত্রে ভারতে এসে অবিভক্ত বাংলার চন্দননগরে বসবাস শুরু করেন এবং এক হিন্দু ব্রাহ্মণ কন্যার প্রেমে নিমজ্জিত হয়ে স্যুট-বুট-কোট ত্যাগ করে ধূতি-পাঞ্জাবী পরে নিখাদ বাঙালী সাজেন ও কবিগানের অনুরাগী হন৷ তাঁর একান্ত উদ্যোগ ও পৃৃৃৃৃৃৃষ্ঠপোষকতায় তখনকার দুর্গা ও কালীপূজায় চন্দননগর, হুগলী এবং কলকাতার আশেপাশে কবিগানের আসর বসত৷ অতঃপর আমাদের দেশ স্বাধীন হয় এবং বঙ্গের পূর্বাংশ পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ নাম নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়৷ দেশভাগ হলেও কবিগানের লড়াই কিন্তু উভয় বাংলাতেই সমানভাবে চলতে থাকে৷

স্বাধীনতার পরবর্তীতে কয়েকজন কিংবদন্তী কবিয়ালের প্রয়াণের পর কবিগানের বিশ্বব্যাপী সার্বিক জনপ্রিয়তা আঞ্চলিকতায় আবদ্ধ হয়৷ পূর্ববঙ্গে তখন চট্টগ্রামের রমেশ শীল, ফণী বড়ুয়া, লোককবি বিজয় সরকার প্রমুখ কবিয়ালগণ কবিগানকে মহিমান্বিত করেন৷ এদিকে পশ্চিমবঙ্গে কবিগানের জনপ্রিয় জুটি মুর্শিদাবাদের জিনদিঘী গ্রামের প্রখ্যাত কবিয়াল শেখ গুমানী দেওয়ান ও বীরভূমের খরুন গ্রামের লম্বোদর চক্রবর্তী সর্বজন প্রশংসিত হন৷ গুমানী সাহেবের আমল হতে কবিগানের বিষয়বস্তুর বিস্তর পরিবর্তন হতে থাকে৷ তিনিই সর্বপ্রথম কবিগানে দেবতার জায়গায় মানবের বন্দনা করে মানুষের কর্ম ও প্রয়াসকে মর্যাদা দেন৷ শ্রোতৃৃৃৃৃৃৃবর্গের রুচি বদলের কারণে কবিগানের গতানুগতিক ধারার পরিবর্তন করে আধুনিক ও সামাজিক বিষয়গুলি উপস্থাপিত করেন, আর সেই কারণেই কবিয়াল শেখ গুমানী দেওয়ানকে আধুনিক কবিগানের জনক নামে অভিহিত করা যায়৷ উক্ত কবিয়ালগণের প্রয়াণের পর অঞ্চলভেদে কবিগানের অনুশীলন ও উপস্থাপন চলতে থাকে এবং তার ফলে কবিগানের সার্বিক উন্নয়নের কর্ম ব্যাহত হয়৷
অতঃপর সাত-আটের দশকে কবিগানের জগতে গুমানী-লম্বোদরের মত এক জনপ্রিয় জুটির উদ্ভব হয় যাঁরা এক ধাক্কায় কবিগানকে বেগবান করে তোলেন৷ এই দুই কবিয়াল বাঁকুড়া জেলার শ্রীচন্দ্রপুর গ্রামের শ্যামাপদ ভট্টাচার্য ও সুবিরাড়া গ্রামের মানিক দাস, যাঁরা তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের পৃৃৃৃৃৃৃৃৃষ্ঠপোষকতায় সমস্ত রাজ্যস্তরীয় অনুষ্ঠানগুলিতে সুনামের সাথে কবিগানের লড়াই পরিবেশন করেছেন৷ কিন্তু দুঃখের বিষয়, কোন কবিগান গবেষকগণের রচনায় তাঁদের কৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃতিত্ত্বের কথা প্রকাশিত হয়নি৷ এরপর নয়ের দশক হতে এক জনপ্রিয় টিম “যামিনী রামকিঙ্কর কবিগান ট্রুপ” কবিগানের জগতে বিরাজমান, যে টিমটি ভারত সরকারের বিদেশ মন্ত্রকের ইণ্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনসের নিবন্ধিকৃৃৃৃৃৃৃত একমাত্র কবিগানের দল এবং অদ্যাবধি সুনামের সাথে সারা ভারতেই ডিজিটাল কবিগান পরিবেশন করে চলেছে৷
বন্দে মাতরম.. জয় হিন্দ
